সুনামগঞ্জের দর্শনীয় স্থান
পরিবারের সকলের সাথে কোন সুন্দর মুহুর্ত কাটানোর অনুভূতি গুলো আলাদা। অনেক দিন ধরেই ভাবছিলাম
পরিবারকে নিয়ে দেশের মধ্যে কোথাও কম খরচে ভ্রমন করে সুন্দর মুহূর্ত কাটিয়ে আসি, যা আমাদের সকলের স্মৃতির পাতায় স্মরণীয় হয়ে থেকে যাবে।
পরিবার নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার মত জায়গা খুঁজতে লাগলাম এবং ঠিক সেই সময়ই আমার প্রাণ প্রিয় ছোট বোন সুনামগঞ্জের কথা বলল, এবং সে সুনামগঞ্জ ট্যুরে যাওয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করল কারন সুনামগঞ্জের দর্শনীয় স্থান গুলো অনেক আকর্ষণীয়।
পরিবারের সকলকে আমাদের আইডিয়ার কথা জানালাম, এবং সকলেই অনেক উচ্ছ্বাসিত হল এবং ট্যুরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করলো। চলুন জেনে নেওয়া যাক আমাদের ভ্রমণের দারুণ অভিজ্ঞতা।
সুনামগঞ্জ ভ্রমণের জন্য যাদের প্ল্যান আছে তারা আজকের আর্টিকেলটি পড়ে ফেলুন আমি চেষ্টা করব আমার ভ্রমণের সর্বশ্রেষ্ঠ অভিজ্ঞতা শেয়ার করার।
আর্টিকেলটি পড়লে আপনারা সুনামগঞ্জের দর্শনীয় স্থান ও ভ্রমনের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে অনেক তথ্য পেয়ে যাবেন।
আরও পড়ুনঃ
সুনামগঞ্জে যা দেখতে পাবেন
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরুপ সাজে সজ্জিত হয়ে আছে দেশের উওর পূর্ব দিকে অবস্থিত এই সুনামগঞ্জ জেলা। নান্দনিক সৌন্দর্য আর অপরুপ সাজে,
নিজ হাতে আঁকা কারুকার্যে ভরপুর করে দিয়েছেন বিধাতা নিজেই। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পাদদেশে অবস্থিত বিশাল জলরাশির টাংগুয়ার হাওর, বারেক টিলা (Barek TIla), যাদুকাটা নদী, লাউড় রাজ্যের ধংসাবাশেষ, পনাতীর্থ।
সীমান্ত হাট, খ্রীষ্টানদের মিশন, সীমান্ত ঘের্ষা পাহাড়, নদী, ছাতকের টেংরা টিলা গ্যাস ফিল্ড, ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরী, সুনামগঞ্জের
মরমী কবি হাছন রাজার মিউজিয়াম, দিরাইয়ে বাউল সাধক পুরুষ শাহ আব্দুল করিম, জগন্নাথপুরে রাধারমন এর কিছু নিদর্শন ও দর্শনীয় স্থান। নিচে সব সুনামগঞ্জের দর্শনীয় স্থানগুলো নিয়ে আলোচনা করা হল:-
টাঙ্গুয়ার হাওর
বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর আর দর্শনিয় অন্যতম বৃহত্তম হাওর হলো সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার টাঙ্গুয়ার হাওর।
ভরা বর্ষায় ফুটে উঠে এই হাওরের ভয়াবহ সুন্দর রুপ। আর শীতকালে হয়ে উঠে হাজার রকমের অতিথি পাখিদের অভয়ারণ্য। পাখির চোখে টাঙ্গুয়ার হাওর এর সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য রয়েছে ওয়াচ টাওয়ার।
হাওরের কোথাও চোখে পড়বে হরেক রকমের শাপলার মেলা, কখনো নানা গাছগাছিলির অপরুপ সাজ, কখনো মিলবে উত্তাল জলের খেলা কখনো শান্ত হয়ে বয়ে চলা।
বর্ষাকালে সুনামগঞ্জ সাহেব বাড়ি ঘাট থেকে সরাসরি ট্রলার রিজার্ভ করে যেতে পারেন। এছাড়া লেগুনা বা বাইকে করে টেকেরঘাট গিয়েও ট্রলার রিজার্ভ করে ঘুরে বেড়াতে পারেন।
বাইকে বা লেগুনা করে টেকেরঘাট গেলে সময় এবং খরচ কম। সুনামগঞ্জ নতুন ব্রিজের ওপার থেকে বাইকে জনপ্রতি টেকেরঘাট ভাড়া নিবে ১৫০ টাকা আর লেগুনা ৫০-৭০ টাকা।
যেতে সময় লাগবে ৪০-৫০ মিনিট। টেকেরঘাট থেকে এবার সারাদিনের জন্য ট্রলার রিজার্ভ করুন। মাঝি ঘুরিয়ে দেখাবে পুরো হাওর।
সারাদিনের জন্য ট্রলার ভাড়া নিবে ২৫০০-২৮০০ টাকা। আর যদি রাত্রে টাঙ্গুয়ার হাওর থাকতে চান তবে ভাড়া নিবে ৩৫০০-৪০০০ টাকা।
সেক্ষেত্রে সুনামগঞ্জ থেকেই বাজার সদাই করে নিবেন। মাঝিরা ট্রলারে রান্না করে দিবে। ট্রলার ভাড়া করার সময় অবশ্যই দামাদামি করে নিবেন।
টাঙ্গুয়ার হাওরের অপরূপ দৃশ্যে আমি আমার পরিবার নিয়ে রাত্রি যাপন করেছিলাম এবং সুনামগঞ্জ থেকে বাজার করে ট্রলারের মাঝি রান্না করেছিলাম বেশ একটা পিকনিক এর মত ফিলিংস হচ্ছিল।
যাদুকাটা নদী
ভারতের মেঘালয়ের খাসিয়া পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত এই যাদুকাটা নদী। এই নদী এক এক সময় এক এক রুপ দেখা যায়। কখনো শান্ত খরা, কখনো ভরা বর্ষায় খরস্রোতা। নদির এপারে লাউড়েরগড় বাজার আর ওপারেই বারিক্কা টিলা।
এই নদিতে বেশিরভাগ সময়ই চলে কয়লা আর নুড়ি পাথর উত্তোলন। শীতকালে এর বেশিরভাগ পায়ে হেটেই পাড়ি দেওয়া যায়, আর দূর থেকে মনে হয় যেন বিশাল এক বালুকাময় মরুভূমি।
এমন সুন্দর পাহাড়ি নদী দেশে মেলা দুস্কর। সুনামগঞ্জ থেকে মোটর বাইক ৮০ টাকা ভাড়া আর লেগুনাতে ৫০-৪০ টাকা ভাড়ায় সহজেই যাওয়া যায় এই যাদুকাটার অপরুপ যাদু দেখতে।
বারিক্কা/বারেক টিলা
যাদুকাটা নদীর ওপারে উচু যে টিলা বা গ্রাম এর নামই বারিক্কা টিলা বা বারেক টিলা। স্থানিয় ভাষায় বারিক্কা টিলা বলেই সবাই ডাকে। এই টিলার উপরেই রয়েছে সীমান্ত কাটা তারের বেড়া।
এর ওপরে যে পাহাড় গুলো দেখা যায় পুরোটাই ভারতীয় সীমান্তের মেঘালয়ের অংশ। ক্যাম্পিং করার জন্য টিলা পারফেক্ট জায়গা।
সকালের সুর্যোদয় দেখার জন্য হতে পারে এই টিলা অন্যতম প্রধান আকর্ষনীয় স্থান। তবে থাকার কোন ব্যবস্থা নেই এই টিলায় ক্যাম্পিং ছাড়া। থাকতে চাইলে চলে যেতে হবে তাহিরপুর বাজারে।
সুনামগঞ্জ থেকে মোটর বাইকে করে লাউড়ের গড় বাজার চলে আসুন, ভাড়া ৮০ টাকা। লাউড়েরগড় বাজার থেকে যাদুকাটা নদি ৫ টাকা নিবে পাড়ি দিতে। যাদুকাটা পার হলেই বারিক্কা টিলা।
শিমুল বাগান
শিমুল বাগান সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলায় যাদুকাটা নদীর কাছে মানিগ্রামে অবস্থিত। প্রায় ১০০ বিঘা জমির উপর এই শিমুল বাগান গড়ে তোলা হয়েছে।
এই বাগানে ৩০০০ এরও বেশি শিমুল গাছ রয়েছে। ২০০৩ সালের দিকে স্থানীয় ব্যবসায়ি জয়নাল আবেদিন এই বাগানটি তৈরি করেন।
তার নাম অনুসারে এই বাগানটির নাম দেওয়া হয় জয়নাল আবেদিন শিমুল বাগান। বসন্তকালে যখন শিমুল ফুল ফোটে তখন গাছের ডালের দিকে তাকালে মনে হয় চোখে লাল আগুনের ঝলকানি লাগছে।
একদিকে মেঘালয় পাহাড় আর অন্যদিকে যাদুকাটা নদীর তিরে শিমুল বাগানের লাল শিমুলের সমাহার যা মনে শিহরন জাগিয়ে তুলতে বাধ্য করবে। যার স্বীকার আমরা হয়েছিলাম।
নীলাদ্রি লেক
বারিক্কা টিলা থেকে ৬০ টাকা বাইকে ভাড়ায় ঘুরে আসতে পারেন টেকেরঘাট চুনা পাথরের এই অদ্ভুত সুন্দর সবুজ এই লেকটি। এই লেকটি সীমান্তের একদম নিকটে। লেকের শেষ প্রান্তের পাহাড়টি ভারতীয় সীমানায়, চুনা পাথরের একটি পরিত্যক্ত ফেক্টরি রয়েছে। সাথেই আছে বৃটিশ আমলের রেল।
লেকের পানি খুব শিতল এবং গভীর এর লেকটির দুই পাশেই রয়েছে টিলা যেখানে দাঁড়িয়ে লেককে আরো মনমত উপভোগ করা যায়। চাইলে লেকের পাশে ক্যাম্পিং করতে পারেন। টেকেরঘাট থেকে নৌকা করে টাঙ্গুয়ার হাওরও ঘুরে বেড়াতে পারেন।
লাকমা ছড়া
টেকেরঘাট বাজারে যে কাউকে জিজ্ঞাসা করলেই দেখিয়ে দিবে লাকমা ছড়ার রাস্তাটি। কিছুদুর হেটে গেলেই পেয়ে যাবেন সীমান্তবর্তি এই অপরূপ সৌন্দর্যে ভরা লাকমা ছড়াটি। তবে সাবধান সীমানা অতিক্রম করবেন না। কারণ এর বেশিরভাগ অংশই ভারতীয় সীমানায়।
হাছন রাজার বাড়ি
সুনামগঞ্জ সদরেই অবস্থিত এই জমিদার বাড়ি। এখানে হাছন রাজার স্মৃতি বিজড়িত আর হাজার তথ্য সমৃদ্ধ একটি মিউজিয়ামও রয়েছে। শহর থেকে রিক্সা/ইজি বাইক যোগে সহজেই ঘুরে আসতে পারেন এই জমিদার বাড়িটি।
ছাতক সিমেন্ট ফেক্টরি ও লাল পাহাড়
ছাতক সিমেন্ট ফেক্টরির জন্য বিখ্যাত সুনামগঞ্জের এই ছাতক উপজেলা। এছাড়াও এখানে রয়েছে দেশের অন্যতম বৃহৎ সিমেন্ট ফ্যাক্টরি লাফাজ। আর এই সিমেন্ট ফ্যাক্টরির পেছনেই রয়েছে ইসলামপুর এর লাল পাহাড়।
এই পাহাড়ের উপর দাড়ালে ভারতীয় বর্ডার সহ আশেপাশে এর প্রকৃতি খুব সহজেই উপভোগ করা যায়। সুনামগঞ্জ থেকে ছাতক বাস অথবা লেগুনা করে যাওয়া যায়।
ছাতক থেকে সুরমা নদী ৫ টাকা দিয়ে পার হয়ে ইজি বাইকে করে ছাতক সিমেন্ট ফেক্টরি যেতে পারেন। সিমেন্ট ফ্যাক্টরির মেইন গেইটের পাশ দিয়ে পিছন দিকে বের হলেই পেয়ে যাবেন সেই লাল পাহাড়।
সুরমা রিভার ভিউ
সুরমা রিভার সুনামগঞ্জ সদরেই সুরমা নদীর পাড়ে মনোরম এক পরিবেশে বসে সুরমা নদীর রুপ সুধা পান করতে চাইলে একটি বিকেল কাটাতে পারেন এই রিভার ভিউ এলাকায়। সদর থেকে রিক্সা/ইজি বাইকে ১০ টাকা ভাড়ায় সহজেই যাতায়াত করা যায়।
সুনামগঞ্জ কিভাবে যাওয়া যায়
ঢাকার আরামবাগ/সায়েদাবাদ/চিটাগাংরোড থেকে শ্যামলি,মামুন পরিবহনের বাসে করে যেতে পারেন, এছাড়াও উত্তরা থেকে এনা পরিবহনে করে যাওয়া যায়। ভাড়া ৫৫০ টাকা।
এছাড়া সিলেটের বাসে করে সিলেট গিয়েও সুনামগঞ্জের বাসে যাওয়া যায়। বাসে করে ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ পৌছাতে মোটামুটি ৫/৬ ঘন্টা সময় লাগে। আর যদি সিলেট থেকে যান তাহলে মাইক্রো বাস ও লোকাল বাসে করে পারেন। ভাড়া নিবে ১৫০-১৭০ টাকা।
আমি এবং আমার পরিবার যেহেতু উত্তরাতে থাকি তাই আমরা উত্তরা থেকে এনা পরিবহন করে সরাসরি সুনামগঞ্জে পৌঁছে গিয়েছিলাম। আমরা রাত এগারটার বাসে উঠেছিলাম এবং সুনামগঞ্জ Sunamganj পৌঁছাতে আমাদের সময় লেগেছিল 6 ঘণ্টা।
থাকার ব্যবস্থা
সুনামগঞ্জ শহরে রয়েছে বেশ কিছু হোটেল থাকার জন্য। তবে অন্যান্য জায়গার তুলনায় ভাড়া একটু বেশি মনে হয়েছে আমার কাছে। বাসস্ট্যান্ড এর পাশে কয়েকটি হোটেল আছে- হোটেল নূর, নুরানি,মিজান,প্যালেস।
এছাড়াও রয়েছে সুনামগঞ্জ সার্কিট হাউজ। আর যারা টাঙ্গুয়ার হাওর বেড়াবেন তারা ভাড়া করা ট্রলারেই রাত্রি যাপন করতে পারবেন অথবা তাহিরপুর এ উপজেলা পরিষদের বাংলোতে থাকতে পারেন। যেহেতু আমি পরিবার নিয়ে গিয়েছি তাই আমরা উপজেলা পরিষদের বাংলোতে থেকেছিলাম।
খাবার ব্যবস্থা
সুনামগঞ্জ শহরে বেশ কিছু ভালো রেষ্টুরেন্ট আছে সেখানে খাওয়া দাওয়া করতে পারেন। এছাড়া যাদুকাটা নদীর পাশে লাউড়েরগর বাজার, বারিক্কা টিলা, তাহির পুরেও মোটামুটি মানের খাবারের হোটেল আছে সেখানেও খেতে পারেন।
আর টাঙ্গুয়ার হাওর বেড়ালে বাজার করে ট্রলারের নিয়ে নিবেন মাঝি পার করে দিবে। যেহেতু আমি পরিবার নিয়ে গিয়েছিলাম তাই আমি খাবারের জন্য হোটেল বুক করেছিলাম।
ভ্রমণের অভিজ্ঞতা
পরিবার নিয়ে সুন্দর একটি ভ্রমণ উপভোগ করার মধ্যে রয়েছে এক অন্যরকম অনুভুতি। আমার অনেক দিনের ইচ্ছা ছিল পরিবারের সকলে মিলে অনেক সুন্দর একটি উপভোগ করা এবং তা সুনামগঞ্জে হবে সেটা আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম।
কারন সুনামগঞ্জের দর্শনীয় স্থান গুলো আমার মনের পাতায় গেথে রয়েছে। আমি আপনাদেরও সাজেস্ট করবো সময় ও সুযোগ থাকলে ঘুরে আসুন সুনামগঞ্জের দর্শনীয় স্থান গুলো।
উপসংহার
আবারও সময়-সুযোগ পেলে আমি সুনামগঞ্জ ভ্রমণের উদ্দেশ্যে যেতে চাই। যদি ভ্রমণের জন্য মন আকুল হয়ে থাকে তাহলে আপনি ঢাকা হতে সুনামগঞ্জ সুন্দর একটি সময় কাটিয়ে আসতে পারবেন এবং যা আপনার স্মৃতিতে দাগ কেটে থাকবে।
এত সুন্দর হাওরের পানি রাজ্যে আপনিও চাইলে হারিয়ে যেতে পারেন। তাহলে আর দেরি কিসের নিজের জীবনের একঘেয়েমি ঘুচাতে আপনিও চলে যেতে পারেন সুনামগঞ্জের দর্শনীয় স্থান ভ্রমনে।